বাংলাদেশি পর্যটকশূন্যে পেট্রাপোল বন্দর!

বাংলাদেশি পর্যটকশূন্যে পেট্রাপোল বন্দর!

বৃহস্পতি, মঙ্গল ও শনিবার- এ তিন দিনে ভারত-বাংলাদেশের নাগরিকেরা কেবল পরস্পরের দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। সপ্তাহের বাকি চার দিনে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয়রা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশে আর যেতে পারছেন না।

আর মহামারিতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মিলছে না যাতায়াতের ছাড়পত্র। দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহন কিছুটা চললেও বড় আকারে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ বহুদিন। এতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ততম স্থল সীমান্তবন্দর পেট্রাপোলের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে।

এক কথায় বলতে গেলে—বাংলাদেশি পর্যটকশূন্য হয়ে ভারতের পেট্রাপোল স্থল সীমান্ত বন্দর এখন ধুঁকছে!

কী ছিল আগে আর আজ কেমন আছে?
যে স্থল সীমান্তবন্দরে প্রায় দিন-রাত থাকতো ভারত-বাংলাদেশি যাত্রীদের আনাগোনা, যে যাত্রীদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকতেন সীমান্তের মুদ্রা ব্যবসায়ীরা, তাদের পরিবহনে যুক্ত থাকা ট্যাক্সি, অটোরিকশা কিংবা বাস; আজ সেই স্থলসীমান্তে সুনশান নীরবতা; অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঝুলছে তালা। যারা খুব প্রয়োজনে দোকান খুলে বসেছেন, তারাও তাস খেলে কিংবা মোবাইল ফোনে কথা বলে অলস সময় পার করছেন।

অথচ আজ থেকে ১৮ মাস আগে ২০২০ সালে ১৩ মার্চ পর্যন্ত এই পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়েই প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার পর্যটক যাতায়াত করতেন। এই পর্যটকদের মধ্যে শুধু বাংলাদেশিদের সংখ্যাই ছিল প্রায় ৬ হাজার।

এত সংখ্যক বাংলাদেশি পর্যটক সীমান্তে ঢুকে মুদ্রা ভাঙাতেন, কেউ জিনিসপত্র কিনতেন, কেউ নিতেন মোবাইল ফোনের সিম। কেউ সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যেতেন নিজস্ব গন্তব্যে। আবার কেউ ট্রেন ধরবেন বলে অটো করে যেতেন বনগাঁ স্টেশনে। কেউবা আবার মালপত্র টানার জন্য মজুর নিতেন, ভাড়া করতেন ভ্যান-রিকশা। দীর্ঘ যাত্রার পর পেট্রাপোলের রেস্তোরাঁগুলো সরগরম থাকতো বাংলাদেশি পর্যটকদের ভিড়ে।

কিন্তু আজ সেখানে একটি খাবারের দোকান খোলা নেই। নৈরাশ্য নিয়ে এক দুটো ভ্যান-রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। যেখানে একটি অটো ধরতে যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লম্বা লাইন দিতে হতো, সেখানে স্ট্যান্ডে প্রায় সব অটোরিকশা নির্বিকার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে। প্রাইভেটকার স্ট্যান্ডেও সারি সারি গাড়ি।

কলকাতা থেকে যে বাসগুলো যাত্রীদের পেট্রাপোল সীমান্তে পৌঁছে দিত, সেগুলোও সীমান্তের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। বাসগুলোর সামনে দাঁড়ালে বোঝা যায়—কতদিন এগুলোর চাকা গড়ায়নি রাস্তায়!
সাভার এন্টারপ্রাইজ নামের একটি বড় মুদ্রা বিনিয়মকেন্দ্র পেট্রাপোলে। সেখানে ৪ জন কর্মী ছিলেন। সেখানে গত দেড় বছরে শুধু দুজন দোকান খুলে বসেন। তাও সকাল ও সন্ধ্যায় ধূপধুনো দেওয়ার জন্য। ওই সংস্থার মালিক মাধব সাহা বলছিলেন, ‘আর কিছুদিন যদি এই অবস্থা চলে, তবে হয়তো দোকান বিক্রি করে দিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হতে হবে।’

অটোস্ট্যান্ডে বসে থাকা শঙ্কর রায় নামের একজন চালক বলেন, ‘ব্যাংক থেকে মোটা সুদে টাকা নিয়ে অটোরিকশা কিনেছিলাম। গত ১৮ মাসে ১৮ হাজার টাকাও রোজগার নেই! শেষ পর্যন্ত অটো বিক্রি করে লোন শোধ করতে হবে। কিন্তু সেটারও তো কোনো রাস্তা নেই। কারণ অটোর ব্যবসা থাকলেই তো মানুষ অটো কিনবেন।’

তবে কি আত্মহত্যাই করতে হবে আমাদের, উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন তিনি।

কবে নাগাদ করোনা সংকট কাটবে, আর কবেই-বা পেট্রাপোল সীমান্তের অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করবে, এমন প্রশ্ন রাখলেন স্থানীয় এক বাসচালক। তিনি বলেন, ‘বাসের চাকায় যেমন ধুলো পড়েছে, আমাদের জীবনেও তেমন ধুলো জমেছে।’

পেট্রাপোল সীমান্তের চিরচেনা ছবিটাও অতিমারির কারণে পাল্টে গেছে! দিনজুড়ে যে কয়েকজন এখনও এপার-ওপারে যাতায়াত করছেন; তারাই এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত। সবার প্রত্যাশা—বৈশ্বিক মহামারি নির্মূল হোক। আবারও আগের মতো প্রাণ ফিরে আসুক প্রতিবেশী দুই দেশের ব্যস্ততম এ সীমান্ত বন্দরে।